
প্রদীপ চন্দ্র মম
বাউলের একতারা আজ রাষ্ট্রদ্রোহী,
তার সুরে নাকি ভাঙে ক্ষমতার দেওয়াল—
তাই এক হাতে লাঠি,
আরেক হাতে ফতোয়ার কাগজ,
গলা টিপে ধরা হলো গানের নিঃশ্বাস।
ভক্তের কপালে নেমে আসে লোহার আঘাত,
সংখ্যালঘুর ঘরে ঢোকে
রাতের পোশাক পরা নেকড়েরা;
মা কেঁপে ওঠে,
শিশু জেগে ওঠে কান্নার চিৎকারে—
আর আকাশ চুপ করে থাকে।
ভিন্নমত আজ ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড,
স্ট্যাটাসে ফাঁসি, কবিতায় গুম;
প্রশ্ন করলেই তুমি নাস্তিক,
তুমি দেশদ্রোহী,
তুমি টার্গেট।
ধর্মের নামে খুলে বসে রক্তের হাট,
লাশ বেচাকেনার মৌসুম চলে বছরজুড়ে;
ক্ষমতার খাতায় লেখা থাকে—
আজ কতজন মরলে ভালো ব্যবসা হলো!
তৌহিদের স্লোগানে কেঁপে ওঠে বাতাস,
কিন্তু সেই ধ্বনিতে ঈমান নেই—
আছে শুধু পেশির গর্জন,
আছে শুধু দখলের হুংকার।
কবর খুঁড়ে তুলে আনে মৃতের নিথর দেহ,
তারপর সেই দেহে আগুন,
আর আগুনের চারপাশে উল্লাস—
ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেয় বিজয়ের উন্মাদনা!
হে মানবতা,
এ কোন উৎসব?
এ কোন ধর্মের জয়গান?
ধর্ম তো বলেছিল—
হত্যা নয়, করুণা;
লুট নয়, সহানুভূতি;
নারীর চোখে ভয় নয়—
নিরাপত্তার আলো।
তবে এ কোন ধর্ম,
যে ধর্ম শিশুর কান্নায় হাসে,
মায়ের লাশে পতাকা ওড়ায়?
ওদের মুখে দাড়ি,
চোখে খুনের খিদে,
হাতে কোরআন নয়—
হাতে আগুন, রড,
দায়মুক্তির সরকারি দলিল।
মানুষের মুখ পরে
দিনে দিনে শয়তান হয়ে ওঠে ওরা—
অন্ধকারের নিয়মিত কর্মচারী।
আমরা তখনও বলে উঠি—
এই দেশ কারও একার নয়,
এই আকাশ ধর্মের ঠিকানায় বিক্রি হয়নি,
এই মাটি কোনো মৌলবাদীর জমিদারি নয়!
লাশের ওপর দাঁড়িয়ে
যারা ক্ষমতা চায়,
তারা ইতিহাসের কাছে শুধু ঘাতক।
তবু হে ঈশ্বর,
তোমার নামেই সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরে!
তোমার নামেই সবচেয়ে বেশি আগুন জ্বলে!
তোমার নামেই আজ
মায়ের বুক শূন্য হয়,
শিশুর ঘুম ভেঙে যায় শ্লোগানের চিৎকারে!
তুমি কি জানো—
তোমার নাম উচ্চারিত হয়
লাশের উৎসবে,
আগুনের বৃত্তে,
হিংসার মিছিলে?
বাউলের একতারা আজও তোমাকেই ডাকে,
কিন্তু সেই ডাক পৌঁছায় না কোথাও—
মাঝখানে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে
ঘৃণার মিনার,
ভুল ব্যাখ্যার প্রাচীর।
হে দয়াময়,
তুমি কি সত্যিই আত্মগোপনে?
নাকি আমরা নিজেরাই
এতটাই অমানুষ হয়ে গেছি
যে তোমার আলো আর সহ্য হয় না?
কবর ভাঙা হয়,
লাশ পোড়ানো হয়,
আর সেই আগুনে মানুষ উল্লাস করে—
এ কেমন প্রার্থনা,
এ কেমন ইবাদত, হে প্রভু?
আমাদের আশা আজ আহত,
রক্তাক্ত স্বপ্নে ভরে গেছে বুক;
চারদিকে শুধু গুম, মিথ্যা মামলা,
ভয়ের রাজত্ব,
নীরবতার শাসন।
তবু কিছু মানুষ এখনও জ্বলে—
ভাঙা কণ্ঠে,
খালি হাতে,
রক্তাক্ত সাহসে।
তারা বলে—
এই অন্ধকারই শেষ নয়।
হে ঈশ্বর,
যদি সত্যিই তুমি থাকো,
তবে নেমে এসো—
এই আগুনের শহরে,
এই ঘৃণার রাজ্যে,
এই শ্বাপদসংকুল পৃথিবীর বুকে।
ভয় পেও না,
আমরা আছি—
তোমার পাশে,
ভাঙা বিশ্বাস,
নুয়ে পড়া হাঁটু,
তবু অটল দু’চোখে।
মানুষ বাঁচাও, ঈশ্বর—
ধর্ম নয়;
মানুষ বাঁচাও—
বিশ্বাস নয়;
মানুষ বাঁচাও—
পতাকা নয়।
নইলে এই পৃথিবী একদিন
শুধু লাশের মানচিত্র হয়ে থাকবে,
আর ইতিহাস লিখবে—
এককালে এখানে মানুষ ছিল,
তারপর ধর্মের নামে
শয়তানরা রাজত্ব করেছিল।
২৬/১১/২০২৫ খ্রিঃ।