প্রদীপ চন্দ্র মম
এই বাংলাদেশ—
শুধু মানুষের সংখ্যা নয়,
এখানে রক্ত জমে থাকে
শীতল ভোরের শিশিরের মতো;
ধানক্ষেতের আল বেয়ে
নিঃশব্দে গড়িয়ে যায় ভয়।
দুই হাজার ছয়শো তেহাত্তরটি ক্ষত—
কাগজে তারা সংখ্যা,
কিন্তু সন্ধ্যায় গ্রামে গ্রামে
পোড়া ঘরের ধোঁয়া
বকপাখির ডানায় জড়িয়ে থাকে।
উপাসনালয়ের ভাঙা ঘণ্টা
আর ডাকতে পারে না—
তার শব্দ আটকে যায়
বাতাসের গলায়।
গণ-অভ্যুত্থানের পর
পতাকাটি উড়েছিল—
মেঘনার বুকে,
শালবনের মাথায়;
কিন্তু সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে
সংখ্যালঘুরা শুনেছিল
আগুনের গোপন পদচারণা।
স্বাধীনতার আলো
সব উঠোনে পড়ে না—
কিছু ঘরে
রাত চিরস্থায়ী।
নব্বইটি মৃত্যু—
সংবাদে তারা ঝরে যায়
শিউলির মতো,
কিন্তু বাড়ির উঠোনে
একটি চেয়ার
শুকনো পাতার মতো
সারা বছর পড়ে থাকে।
তেহাত্তরটি অভিযোগ—
ধর্মের নামে;
অথচ অপমানিত হয়
মানুষের নরম মুখ।
রাষ্ট্রের ঘুমন্ত বিবেক—
যেন কুয়াশায় ঢাকা নদী।
ডিসেম্বর আসে—
বিজয়ের শীতল রোদ নিয়ে;
কিন্তু দিপু চন্দ্র দাসের নাম
আরও কয়েকটি প্রাণের সঙ্গে
রক্তমাখা ক্যালেন্ডারে
পলাশফুলের মতো
লাল হয়ে ঝুলে থাকে।
এই কি বিজয়—
যেখানে শীতের হাওয়ায়
লাশের গন্ধও উড়ে বেড়ায়?
এখন ধর্ম আর প্রার্থনা নয়—
এ যেন জমির খতিয়ান,
ভোটের অঙ্ক,
ক্ষমতার আঁধার বন।
যারা আঘাত করে
তারা জানে—
বিচার এখানে
বর্ষার নদীর মতো;
হঠাৎ ফুলে ওঠে,
আবার মিলিয়ে যায় বালিতে।
নারী, পুরুষ, কিশোর—
সবাই এই অন্ধকারের পথিক।
ধর্ষণ, লুট, আগুন—
আর উপাসনালয়ের ভাঙা দরজায়
ঈশ্বর নিজেও
আজ ঘাসফড়িংয়ের মতো
পালিয়ে বেড়ায়।
রাষ্ট্র বলে—
“আমরা দেখছি।”
কিন্তু দেখা আর দেখার মাঝে
আরেকটি ঘর পুড়ে যায়,
আরেকটি নাম
নদীর বাঁকে
নীরবে ডুবে যায়।
মানবাধিকারের কাগজে
শব্দ আছে,
কিন্তু মাঠে, গ্রামে
মানুষ বন্দি থাকে
কুয়াশার ভেতর।
বৈচিত্র্যের কথা শোনা যায়—
তবু ভিন্ন হওয়া মানে
এই দেশে
একলা শালগাছ হয়ে দাঁড়ানো।
পাশের দেশের উদাহরণ টেনে
ঘৃণা আসে
ঝড়ের ধুলোর মতো,
আর দায় চাপানো হয়
এ দেশের সংখ্যালঘুর কাঁধে।
তারা কি সীমান্ত পেরিয়েছে?
না—
তারা শুধু
ভিন্ন নামে জন্মেছিল
এই নদী, এই মাটির ভেতরেই।
হে রাষ্ট্র,
তুমি যদি ন্যায়বিচার না হও,
তবে তুমি কেবল
নদী–নামহীন এক মানচিত্র।
মানচিত্রে মানুষ থাকে না—
থাকে না কান্না,
থাকে না রাতজাগা প্রার্থনা।
আজ প্রশ্ন সংখ্যার নয়—
প্রশ্ন সাহসের।
সংখ্যালঘুর নয়,
সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতাই
এই অন্ধকারের
সবচেয়ে ঘন কুয়াশা।
যদি এখনো না জাগো—
তবে কাল
এই কবিতাটিও
কোনো এক তালিকায়
ঝরে পড়া পাতার মতো
আরেকটি সংখ্যা হয়ে থাকবে।
২৮/১২/২০২৫ খ্রিঃ।