
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক অদ্ভুত সংকটে পড়েছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রের রাজনীতিতে যে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও অংশগ্রহণমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতি ছিল—সেটি আজ অনেকটাই কাগজে সীমাবদ্ধ। রাজনীতি এখন আর নীতি ও আদর্শের জায়গা নয়, বরং তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতার খেলায়, ব্যক্তিস্বার্থের যুদ্ধে এবং দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায়।
গণতন্ত্রের মুখোশে কর্তৃত্ববাদ
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও বাস্তবে চলছে একধরনের কর্তৃত্ববাদ। বিরোধী মতকে দমন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, এবং প্রশাসনের দলীয়করণ—সব মিলিয়ে রাজনীতি থেকে জনগণের আস্থা ক্রমেই সরে যাচ্ছে। এখন আর ভোট মানে জনগণের মত নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থার অনুমোদন।
এক সময় যেখানে রাজনীতি ছিল “মানুষের অধিকার আদায়ের মাধ্যম”, এখন তা “ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার”।
বিরোধী রাজনীতির দুর্বলতা ও বিভাজন
বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতি আজ সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে। আদর্শিক রাজনীতির জায়গায় এসেছে স্বার্থভিত্তিক নেতৃত্ব। একদিকে সরকারি দল প্রশাসনিক শক্তিতে বলীয়ান, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো নিজেরাই ভেতরে বিভক্ত, নেতৃত্বে অস্থির, আর মাঠে নিষ্ক্রিয়। জনগণের ভরসার জায়গা হারিয়েছে তারা।
এই অবস্থায় জনগণ নতুন বিকল্পের সন্ধান করছে—যে বিকল্প হবে সৎ, আদর্শিক ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতীক।
তরুণ প্রজন্মের বিমুখতা
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা রাজনীতিকে এখন “দুর্নীতি, হিংসা ও সুবিধাবাদ” এর প্রতীক মনে করে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের সব বড় আন্দোলন তরুণদের হাত ধরে হয়েছে—ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। আজ সেই প্রজন্মকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা জরুরি, কারণ আদর্শহীন রাজনীতি যতদিন চলবে, ততদিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকবে।
অর্থনীতি ও রাজনীতির যোগসূত্র
অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা রাজনীতির অস্থিরতার ফল। সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, ডলার সংকট—এসবই রাজনৈতিক জবাবদিহির অভাবের কারণে। রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ সরকার না থাকলে অর্থনীতি কখনো স্থিতিশীল হতে পারে না। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক সংস্কার—যেখানে থাকবে স্বচ্ছতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসন।
মিডিয়া ও মতপ্রকাশের সংকট
গণমাধ্যম এখন আর পুরোপুরি স্বাধীন নয়। সরকারের সমালোচনা মানেই “রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম”—এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে গেলে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি জন্ম নেয়, আর ভয়ভীতির মধ্যে কখনোই গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না।
সমাধানের পথ
১. রাজনীতিতে নৈতিকতার প্রত্যাবর্তন — রাজনীতি হতে হবে নীতির, আদর্শের ও জনগণের কল্যাণের জায়গা।
২. নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার — নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও অবাধ ভোটের পরিবেশ ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না।
৩. বিরোধী দলগুলোর ঐক্য — জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে বিরোধীদের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য দরকার।
৪. তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ — রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে হবে, যাতে পুরনো দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তা আসে।
৫. আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা — এটি ছাড়া কোনো সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জনগণ এখন পরিবর্তন চায়, কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে সেই পরিবর্তনের পথ অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো — আদর্শভিত্তিক, সৎ ও সাহসী নেতৃত্বের উত্থান।
রাজনীতি যদি জনগণের সেবায় ফিরে আসে, তবে এই দেশ আবারও বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু যদি রাজনীতি থাকে ক্ষমতার খেলার মধ্যে, তবে হতাশার এই অন্ধকার আরও ঘনীভূত হবে।
আল আমিন মিলু
আহ্বায়ক
গনঅধিকার পরিষদ সরিষাবাড়ি উপজেলা শাখা জামালপুর