কামরুল হাসান :
আলগা মানে যা বাঁধা বা বান্ধা নয়। অর্থাৎ গভীর নয় এমন। দরদ মানে মায়া, মমতা ও সহানুভুতি ইত্যাদি। হলে বলতে এখানে পরীক্ষার হলে বোঝানো হয়েছে। ক্লাসে মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের সময়। বাংলা প্রবাদে আছে- ‘আলগা দরদ ঢেঁপের খই, এত দরদ পাইলি কই?’
চলতি মওসুমে চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার দক্ষিন জামালপুরের ২০৫, ২০৭, ২১০, ২১৩ ও ৮৬৪ নং কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে ভালোভাবেই বুঝেছি যে, কেন্দ্রগুলোর দুয়েকটিতে বিশেষ এক শ্রেণির ঠিকাদারদের ব্যবসা জম জমাট। তবে কোন কেন্দ্রে একটু বেশিই, আবার কোন কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত কম। এ বিষয়ে অন্তত: কোন কেন্দ্রেরই দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলফ করে বলতে পারবে না যে, তার কেন্দ্র একেবারে ভেজাল বা দোষমুক্ত। অর্থাৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা ভালো ফলাফল পাইয়ে দেয়ার ব্যবসা করেন। সহজভাবে বলতে গেলে, ভালো ফলাফল পাইয়ে দেয়ার ঠিকাদারী করেন। ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত গণিত বিষয়ের পরীক্ষার দিন প্রশাসন বিশেষ কারিশমা দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিয়েছে। এতে শিক্ষানুরাগী ও সচেতন মহল অনেকটাই খুশি হয়েছে। কিন্তু খুশি হতে পারেনি ঠিকাদাররা। কারন প্রশাসনের কারিশমায় তাদের ব্যবসা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবুও ঠিকাদারদের তৎপরতা কিন্তু থেমে নেই। তারা দু:সাহসিক এক পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের উদ্দেশ্য ঠিকই হাসিল করেছে। তা নাহলে যে, তাদের কাছে আসা সেবা প্রত্যাশিরা একদিকে যেমন মুখ ফিরিয়ে নেবে। অপরদিকে ঠিকাদাররাও যে একেবারে মাঠে মারা পড়বে। গেল ১০, ১৫, ১৭ ও ২১ এপ্রিল ২০৭ নং কেন্দ্রে খোঁজ-খবর নিয়ে ধর্তব্য তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। পক্ষান্তরে অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ কেন্দ্র সচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যদের প্রতি একটু বেজারই হয়েছেন। কারন- এ কেন্দ্রের প্রত্যেকটি পরীক্ষাই কোন রকম ছাড় না দিয়ে বরং কড়া ডিউটির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে স্বাগত প্রতিষ্ঠানের সহ-শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের কড়া ডিউটির জন্য অন্যসব প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের অভিযোগের অন্ত: ছিলনা। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষক তারপর থেকে স্বেচ্ছায় ডিউটি বাতিল করেছে। ২২ এপ্রিল ২১০ নং কেন্দ্রের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাহির থেকে দেখলে কেন্দ্রের পরিবেশ খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু কিন্তু ছিল। এ কিন্তুটাই এক বিশেষ কিন্তু। মানে আলগা দরদ আর কি! ২৪ এপ্রিল ২০৫, ২১৩ ও ৮৬৪ নং কেন্দ্রের খোঁজ-খবর নিই। ২০৫-এ বরাবরই বিশেষ দরদ দেখানো হয়। তাই এবারেও দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ২১৩-তে ‘বাইরে ফিটফাট আর ভেতরে সদর ঘাট।’ ৮৬৪ নং কেন্দ্রটি দাখিলের। যেহেতু এটি একটি ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়, সেহেতু তারা পূর্ব থেকেই কিঞ্চিত হলেও ছাড় পেয়ে আসছে। ২৭ এপ্রিল (গোপন সংবাদের ভিত্তিতে) ২১৩ নং কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা যায়, এক পরীক্ষার্থী কাজল নামের এক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা দাবি ও নেয়ার অভিযোগ তুলে খোদ কেন্দ্র সচিবের নিকট। এ ছাড়া তাদের চাহিদা মোতাবেক (অতিরিক্ত) টাকা না দিলে পরীক্ষায় ফেল বা বহিষ্কারের হুমকি দেয়ারও অভিযোগ উঠে। পাশাপাশি ঠান্ডা মাথায় সূ² পরামর্শ দেন- এ ব্যাপারে কাউকে বিচার দিয়ে কোন লাভ নেই। কারন, দায়িত্ব প্রাপ্ত বড় কর্তা ব্যক্তিরা গোপনে তাদের রোল নম্বার টুকে নিয়ে এসফেল করবেন। কেউ জানবেও না। তাহলে তার ক্ষতি বিনা কোন লাভ হবে না। ভালো ফলাফলের জন্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নামে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫’শ টাকা করে আদায় করেছে রেজিষ্ট্রেশনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান। এ কাজে সহযোগিতা করে মেহেদী হাসান নামের কর্মচারীকে। চাপের পড়ে সংশ্লিষ্টরা আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকা ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি নামে প্রচার করছে। অথচ পরীক্ষার ফরম পূরণের সময়ই ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি নেয়া হয়। এ বিষয়টা তো আর সহজ সরল মানুষ জানে না। বিশেষ করে যে সব প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন করার ক্ষমতা নেই তারা বাধ্য হয়েই অন্য প্রতিষ্ঠানের দ¦ারস্থ হয়। সে সব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা অবধারিত। ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-‘সত্যকে পাওয়া যায়Ñভুলের মধ্য দিয়ে।’ কিন্তু আমরা বাঙালিরা এমন মানুষ হাজার ভুল করেও সত্যকে খুঁজে পাই না। বরং সত্য খুঁজার জন্যই যেন একের পর এক ভুল করে চলছি। এক্ষনে গল্পের পাগলের কথা মনে পড়ে গেল-এক পথচারী এক পাগলকে বলে, এই পাগল সাঁকো নড়াসনে যেন, তাহলে পড়ে যাব। অমনি পাগল বলে-মনে করিয়ে দিলি কেন? বলেই সাঁকোতে জোরে জোরে ঝাঁকুনী দেয়। আর পথচারী বেচারা পড়ে যায়। ঠিক ওরাও যেন এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে। কারন, আমরা বাঙালিরা আর কিছু পারি বা না পারি অপকৌশল কিভাবে প্রয়োগ করতে হয় তা ঠিকই পারি। যেমন- এক বাঙালি বিদেশ গিয়ে ফ্ল্যাট বানানোর জন্য এক বিল্ডিংয়ে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার জায়গা কিনছে। সে ফ্ল্যাট বানানোর সময় যে উচ্চতার জায়গা কিনছে, ঠিক এক ফুট ফাঁকা রেখে তার নিচ পর্যন্ত কাজ করে। অন্য আরেক বাঙালি লোক ্ওই বিল্ডিংয়েই তার উপরে ফ্ল্যাটের জায়গা কিনে। তিনি কাজ করতে গেলে বাঁেধ যত গন্ডগোল। আগের বাঙালি পরের বাঙালিকে তার এক ফুট (ফাঁকা অংশ) রেখে কাজ করতে বলে। অর্থাৎ বাঙালিরা অন্যকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বড় ওস্তাদ। অনেক মাস্টর পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের আলগা দরদ দেখান মানে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেন। তারাই কিন্তু পরীক্ষার্থীদের বেশি বেকায়দায় ফেলছে। মানে ‘আগা কেটে গোড়ায় পানি ঢালছে।’ আলগা দরদ দেখিয়ে ‘গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার কোন মানে নেই।’ কিন্তু ‘কে শুনে কার কথা’। বিষয়টা যেন এমন-‘কানে গুজেছি তুলা, পিঠে বেঁধেছি কুলা’। দু:খ করে রবি ঠাকুরের কথায় বলতে হয়-‘সব এক জোট হ্যায়’। কারন-‘উপায় নেই, গোলাম হোসেন।’ তাই বলতে হচ্ছে-‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকতে অন্ধ’। আগে আমাদের ভাবতে হবে- ‘ শর্ষের ভ‚ত তাড়াবে কে?’ আবার রবি ঠাকুরের ভাষায়- ‘হে অবরুদ্ধ বঙ্গজননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ তো করনি’। অতএব-‘আবার তোরা মানুষ হ ’\ (লেখক- মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, ফিচার ও কলাম লেখক)