মাওলানা শামীম আহমেদ
সাংবাদিক ইসলামি কলামিস্ট।
১লা মে আর্ন্তাজাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। এই দিবস উপলক্ষে পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং শ্রমিক সংগঠন এই দিবসে শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কথা বলে। নানা আয়োজনে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে।
আজ আমরা আলোচনা করব কুরআন এবং সুন্নাহ তথা ইসলাম শ্রমিককে কী মর্যাদা ও অধিকার দেয় সে বিষয়ে। আজকের মানবাধিকার সংস্থা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর জন্মেরও শত শত বছর আগে কুরআন এবং সুন্নাহ তথা ইসলাম শ্রমিকদের যে-সকল মর্যাদা এবং অধিকারের কথা বলেছে, তা আমরা বেশির ভাগ মানুষই জানি না। এ বিষয়ে কুরআন এবং সুন্নাহর বক্তব্য জানার পরে আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে যাবে যে, মুসলিমকে মানবিক হওয়ার জন্য, মানবাধিকার শেখার জন্য, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য কোনো মানবাধিকার সংস্থা বা সংগঠনের দ্বারস্থ হওয়ার আদৌ প্রয়োজন নেই। বরং এই বিষয়ে কুরআনুল কারীমে রয়েছে সুস্পষ্ট ও বিশদ নীতিমালা এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতে কিছু মানুষকে মালিক আর কিছু মানুষকে শ্রমিক করে বানিয়েছেন। কেন তিনি এই তারতম্য রেখেছেন, তাঁর এই তারতম্যের পেছনে প্রজ্ঞাপূর্ণ যুক্তির কথা তিনি আলোচনা করেছেন সূরা যুখরুফের একটি আয়াতে। তিনি ইরশাদ করেছেন
‘আমিই তাদের পার্থিব জীবনে জীবিকা বণ্টন করি এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। তারা যা সঞ্চয় করে তার চেয়ে তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ উত্তম।’ (সূরা যুখরুফ: আয়াত ৩২)
অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা কিছু মানুষকে মালিক বা উপরে রেখেছেন আর কিছু মানুষকে তাদের অধীন বা শ্রমিক করে রেখেছেন। আর এটা এজন্য যে, যদি এটা না হতো তাহলে পৃথিবীর বর্তমান যে ধারা আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে স্থিতিশীলতা এবং স্বাভাবিকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটি থাকত না; এটি ব্যহত হতো। অতএব আল্লাহ তায়ালা সকল প্রজ্ঞাবানদের সেরা এবং শ্রেষ্ঠ। তিনি আহকামুল হাকিমীন। তাঁর প্রতিটি বণ্টনের পেছনে রয়েছে অনেক প্রজ্ঞাপূর্ণ যুক্তি এবং ব্যাখ্যা।
তবে এই ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রণিধানযোগ্য। ১. আল্লাহ তায়ালার কাছে মানুষের সম্মানিত হওয়া নির্ভর করে ব্যক্তির আমলের ওপর, কর্মের ওপর। মানুষ যখন সৎকর্মশীল হন, নেককার হন, ভালো মানুষ হন, অসৎ এবং মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন— তখন তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে মর্যাদাবান হিসেবে বিবেচিত হন। এক্ষেত্রে তার পেশা মোটেও বিবেচ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন
‘নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে মুত্তাকীগণ সবচেয়ে সম্মানিত।’ (সূরা হুজরাত: আয়াত ১৩)
অতএব বোঝা গেল, আল্লাহ তায়ালা কাউকে শ্রমিক এবং কাউকে মালিক করে রাখলেও এটা অত্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য। আল্লাহ তায়ালার কাছে কিয়ামতের দিন মার্যাদার আসনে আসীন হবেন সেই ব্যক্তি, যার কর্ম দুনিয়ায় সবচেয়ে ভালো থাকবে এবং যিনি সৎকর্মশীল এবং নেককার বান্দা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীর স্বাভাবিক ধারাকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে কিছু মানুষকে শ্রমিক করে রাখলেও ইসলাম সুস্পষ্টভাবে তাদের অধিকার এবং মর্যাদার কথা আলোকপাত করেছে। এছাড়া শ্রমিক তার মালিকের অধীন হলেও আল্লাহ তায়ালা কোনো কোনো দিক দিয়ে তাকে তার মালিক থেকেও ধনী, সমৃদ্ধ, সম্মানিত ও সুখী করে রেখেছেন; যা অনেক সময় আমরা আঁচও করি না বা টেরও পাই না। এই পৃথিবীতে জীবিকা নির্বাহের যত ব্যবস্থা রয়েছে, যত উপায় রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে উত্তম জীবিকা হলো শ্রমিকের জীবিকা। এ-বিষয়ে সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে নবী (সা.) বলেছেন
‘সে ব্যক্তির চেয়ে উত্তম খাবার কেউ খেতে পারল না, যে ব্যক্তি নিজ হাতে উপার্জন করে খেয়েছে।’ (সহীহ বুখারী: হাদীস নম্বর ২০৭২)
নবী (সা.) আরো বলেন
‘আল্লাহার নবী দাঊদ (আ.) নিজের হাতে উপার্জন করে আহার যোগাতেন।’ (সহীহ বুখারী: হাদীস নম্বর ২০৭২)
দাঊদ (আ.) ছিলেন তার যুগে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন। একজন রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি লৌহশিল্পের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সহীহ মুসলীমের এক হাদীসে এসেছে, যাকারিয়া (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। এছাড়া অধিকাংশ নবী-রাসূলই ছাগল বা বিভিন্ন গাবদি পশুর রাখাল ছিলেন। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে মর্যাদাবান, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলেন আম্বিয়া (আ.)। সেই নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ তায়ালা শ্রমিকদের কাতারে রেখেছেন। সকল নাবী-রাসূলই কোনো না কোনো ক্যাটাগরির শ্রমজীবী ছিলেন। এ থেকে ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা অত্যন্ত পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠে। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে যেসব নির্দেশনা দেয় তা হলো—
পারিশ্রমিক: শ্রমিকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার পারিশ্রমিক। কুরআন কারীমের একশত পঞ্চাশ জায়গায় আল্লাহ তায়ালা পারিশ্রমিকের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ একজন শ্রমিকের পারিশ্রমিকের বিষয়টিকে কুরআনুল কারীমে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, একশত পঞ্চশ জায়গায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এক আয়াতে বলেন,
‘তোমরা মানুষকে কোনো কিছুতে ঠকাবে না।’ (সূরা হূদ: আয়াত ৮৫)
শ্রমিকের চেয়ে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে শক্তিশালী করে রেখেছেন, এই কারণে আপনি কোনো অবস্থায় তাকে ঠকাতে পারেন না। এটাই ইসলামের শিক্ষা এবং নির্দেশ। সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, নবী (আ.) হাদীসে কুদসীতে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বয়ং বাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হব। আল্লাহর মামলা হবে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তাদের একজন হলো, যে ব্যক্তি অধীনস্থ শ্রমিককে পারিশ্রমিক দেন নি। কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নিজে এই জালেম ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদীর ভূমিকায় থাকবেন। সুনান ইবনে মাজাহর এক হাদীসে এসেছে, নবী (সা.) বলেছেন,
‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার পারিশ্রমিক প্ররিশোধ করুন।